নবিনামা – ১

নবিনামা

সায়ীদ আবুবকর

প্রথম সর্গঃ

আবির্ভাব

আমাকে ভিজিয়ে দাও ক্ষমার বর্ষণে;

তাঁর পুণ্য নাম মুখে আনার আগেই

এ বুক বিদীর্ণ করে করো কাওসার;

দু-ঠোতে বাজার ভাগে মহম্মদ ধ্বনি

এ ঠোঁটে বানিয়ে দাও বেহেস্তের বাঁশি;

কাব্যের লালিত্যে তাঁকে ছোঁয়ার আগে্‌,

পুস্পের বাগান করো আমার মস্তিস্ক,

কেবলি যেখান থেকে উড়বে সৌরভ,

যে- সৌরভে স্বর্গমর্ত্য হবে সুরভিত!

আমি গনাহগার, প্রভু; তবু তার প্রেম

এ হৃদয়ে ফুল্লধারা দিয়েছে বহায়ে,

যাকে তুমি ভালোবাসো, যার জন্য তুমি

করেছ তুমি সব কুল- মাখলুক,

যার বক্ষদেশে ; তুমি তাঁর প্রশংসায়

হয়েছো মুখর মহাপ্রবিত্র কিতাবে,

করো হে জগদ্বাসী। তুমি যার স্তুতি

করো হে জগতপতি উচ্ছ্বসিত স্বরে

আমি কোন ছার, থাকি নির্লিপ্ত নির্জীব,

হবো না নিমগ্ন তাঁর মহাগুণগানে !

যদি কও ,তুচ্ছ তুই,গাহিবি কীভাবে

এত উচ্চগাথা ; তএ এই তুচ্ছজনে

দাও ঢেলে শক্তি তুমি মহাশক্তিধর,

প্রঞ্জার, প্রেমের আর কাব্য- কৌশলের।

তোমার শক্তির কথা কিবা আমি কবো,

যে- তুমি নির্মাণ করো শুধু কুন বলে

জমিন ও খাম্বাহীন সপ্ত আসমান

ছয় দিনে , মহাশূন্যে; যে তুমি রেখেছ

সৃষ্টি করে এরকম জন্তু অগনণ

তোমার জিম্মায়ঃ করে যদি অকস্মাৎ

বিদ্রোহ কস্মিনকালে এ মহাবিশ্বের

সব সৃষ্টি একসাথে, একটি যদি ছাড়ো,

মুহূর্তে ফেলবে খেয়ে একটি মাত্র গ্রাসে

তাবৎ সৃষ্টিকে, তুমি মহাজাদুকর,

একই মৃত্তিকা থেকে ওঠাও উদ্ভিদ

কত না জাতের , দিচ্ছে কেউ মহাফল,

কেউ তিতে কেউ টক, আবার তাদের

ডালে ডালে, কান্ডে কান্ডে, পাতায় পাতায়

কি- বিচিত্র রঙ! সাত সমুদ্রের পানি

হতো যদি কালি, প্রসস্থ জমিন হোতো

লিখবার খাতা , অরণ্যের তরুরাজি

লেখার কলম, তোমার শক্তির কথা

শেষ করা যেতো না তো লিখে! সে শক্তির

এক অনু- পরমাণু ধ্বংশ করে দেবে

মুহূর্তেই, পারমাণবিক চুল্লি যত

আছে পৃথিবীতে ; রাশিয়া- যুক্তরাষ্ট্রের

উল্টে যাবে চোখ বিস্ময়ে, আতঙ্কে। সেই

তুমি হান যদি কৃপাদৃষ্টি এ অধমে,

আমার কবিতা হয় আনন্দসাগর

আছড়ে আছড়ে পড়বে যার ঢেউ- উপঢেউ

মানবহৃদয়ে।দেব ও দেবীর স্তুতি

মহাকাব্যে এতকাল করেছে কবিরা

নতশিরে, আমার উন্নত শির, প্রভু

জানেনা প্রণত হতে, তোমার সত্তার

কাছে ছাড়া; রাত্রিদিন তোমার সিজদায়

পড়েছে হুমড়ি খেয়ে অস্তিত্ব আমার

মহাত্রাসে; কি আছে অন্তরে তুমি জানো,-

তুমি তা দিও না নাথ যদিতা অনিষ্ট

বয়ে আনে এজগতে তোমার রশ্মিতে

বরং বিশুদ্ধ করে তাই তুমি দাও

আছে যাতে সুকল্যাণ, তোমার সন্তস্টি

আর যুগ- যুগান্তরের মানব চিত্তের

মহাশুদ্ধি, মুক্তি আর আনন্দ আহার

জগত উঠল কেঁপে। বাসন্তবাতাস

তুললো হৃদয়ে শত- শতাব্দীর

প্রতীক্ষা প্রহর ভেঙে করে খান খান

নতুন নক্ষত্র এক, ক্ষণিকের জন্য

মক্কার আকাশে হোল উদিত হঠাৎ

বিদ্যুতের মতো দিল যে ঝলকানি

ধাধিয়ে দুচোখ সব ঋষি- মনীষীর।

ছুতে গিয়ে সি রাত্রে জনৈক সেই ইহুদি

মদিনার দুর্গ- শিরে জুড়ল সেই চিতকারঃ

‘ইহুদি সমাজ শোনো’,সুপ[ত লোকজন

ছুতে এল উদ্ধশ্বাসে, “কি হয়েছে কও।

কী জন্য গাধার মতো করছ চিৎকার”?

সে বলল, “পুন্য রাত্রি আজ এ রাত্রিতে

উঠে গেছে আহমদ নামের নক্ষত্র।

খোদার কসম আমি দেখেছি স্বচক্ষে

উদিত হতে তা দূর মক্কার আকাশে।

ইহুদিদের দুর্ভাগ্য, তাদের রাজত্ব

হয়ে গেল হস্তচ্যুত আজ হতে; হায়,

তাদের ভেতর থেকে আসবেনা আর

নবি কোন দিন! তাদের নিকট থেকে

নবুয়ত চিরতরে নিল বিদায়!”

বললো সবাই, “কি বোঝাতে চাও তুমি?”

সে বললো, “এসে গেছে সর্ব শেষ নবি

মানুষের মধ্যে। খোঁজো মক্কা নগরীর

কোন রমণীর গর্ভে জন্ম নেছে কি না

কোন পুত্র শিশু আজ শেষ রজনীতে।”

ইহুদি এক বললো এক আক্ষেপে,

“বদন সিপ আমাদের , যদি সত্য হয়

তোমার একথা। সূর্য ওঠার আগেই

হয়ে যাব রওনা আমি ব্যবসার কারণে

মক্কার উদ্দেশ্যে। তোমরা নিশ্চিত থাকো

আমি এর সন্ধান নেবোই। যদি এর

একচুলও অন্যথা করি, তবে বলতে পারো

মিথ্যে ছিলো আমার মা, এবং পিতাও।”

লোকেরা বাহবা দিলো তাঁর কথা শুনে ।

কোরাইশ সর্দার আব্দুল মুত্তালিব

উঠলো নিশিতে জেগে ধড়ফড় করে।

শুনলো সে আসমানে কিসের গর্জন,

যার প্রতিধ্বনি তাঁর হিতপিন্ড ফুঁড়ে

আছড়ে পড়তে লাগলো রাতের বাতাসে।

দৌড়ালো সে উদ্ভ্রান্তের মতো সে শব্দের

পাছপাছ, যেভাবে দৌড়ায় বজ্রধ্বনি

বিজলির পশ্চাতে। থমকে দাঁড়ালো সে

পবিত্র কাবার সম্মুখে। অদ্ভুত কাণ্ড

দেখলো সে নিস্তদ্ধ নিরবাকঃ নড়তেছে

খর্জূরপত্রের মতো রাত্রির বাতাসে

কাবা গৃহ। অন্তরাত্মা উঠলো তাঁর কেঁপে

ভয়ে, রক্ষক সে এ গৃহের; গোত্রপতি;

মক্কানগরীর সর্বোউচ্চ সর্দার ; তাঁর

হাতে জগতের শ্রেষ্ঠ উপাসনালয়

কাবার স্বর্ণের চাবি, মূর্খ আবরাহা

যে ঘর ভাঙতে এসে ধ্বংস হয়ে গেছে,

বিশাল হস্ত বাহিনী তাঁর হয়েছে

নিশ্চিন্ন,ঝঞ্ঝার মতো ধেয়ে আসা ক্ষুদ্র

আবাবিল পাখির নিক্ষেপ কড়া তুচ্ছ

নুড়ির আঘাত; সে- দৃশ্য স্মরণ করে

ভাবতে লাগলো বৃদ্ধ কাবার রখকঃ

“কার ভয়ে নড়ে আজ খোদার সে ঘর?

পারেনি ভাঙতে যা রাজাবাদশারা, বিনা

যুদ্ধে কেবলি বাতাসে পড়বে তা ধবসে

রাত্রির আধারে?” তাকাল সে কৌতূহলে

কাবার ভেতর ; দেখল সমস্ত মূর্তি-

আল-লাত,আল-উজ্জা, মানাত, হুবাল

মালাকবেল, বালসামিন, দুসারা নেরগল

মানাফ, আতারসামাইন, রুদা, সাদ, নুহা

পড়েছে উপুড় হয়ে;  হতভম্ব হয়ে

তাকাল আরব নেতা উধবাকাশেঃ দেখল

শুভ্রশিরস্ত্রান পড়ে অজস্র ফেরেস্তা

নিম্ন আসমানে এসে করতেছে পাঠ

খোদার তসবিহ।ভীতসন্ত্রস্ত অন্তরে

ফিরিয়ে আনল দৃষ্টি মর্ত্যে; দেখল সে

রুদ্ধবাক, বৃক্ষরাজি, কেবলামুখো হয়ে

নুয়ায়ে দিয়েছে শির। দিব্যদৃষ্টি তাঁর

খুলে গেল অচিরাৎ; দেখল দিব্যচোখে

বিশ্বময় পড়েছে উপুড় হয়ে যত

মহামূর্তি মন্দিরে মন্দিরে ; আর যত

স্বর্ণ সিংহাসন দেশে দেশে, অহংকার

ক্রোধ , রক্তপাত আর মুণ্ডু দিয়ে মোড়া।

তাহলে কি এ রজনী মহাবপ্লবের

দিতেছে ইঙ্গিত দিকে দিকে! সিরিয়ার

রাজসিংহাসন হয়ে আছে কেবলামুখো

যেন কেউ পরম বিশ্বাসে পড়ে আছে

শান্তি-সিজদায়। পারস্যের দিকে ফিরে

দেখল তাঁর শ্বেত প্রাসাদ কাপতেছে থরথর

আর তার মহামূল্য রাজ সিংহসন

পড়েছে হুমড়ি খেয়ে , যেন কার ভয়ে।

রোমসাম্রাজ্যের দিকে ফিরে দেখল সে

দিব্যচোখে একই দৃশ্য কি -বিস্ময়কর!

যত দ্যাখে তত বৃদ্ধ আরব-সর্দার

হয়ে যায় হতভম্ব। মহাঘোর এসে

করেছে আচ্ছন্ন তাঁকে; চক্ষু জুড়ে তার

উথলে পড়েছে আলো, বুকে অস্থিরতা;

শরীরে কম্পন। অদৃশ্য আওয়াজ এলো

আসমান থেকে ভেসে ,”ভয় পেয়ো না হে,

কুরাইশ নেতা।” দৃষ্টি তার গেল ছুটে

আমিনার গৃহে। প্রানাধিক প্রিয় পুত্র

চলে গেছে পরপার গর্ভবতী স্ত্রীকে

রেখে ধরাধামে । ঘনিয়ে এসেছে তাঁর

প্রসবের কাল।আরব সর্দার তিনি;

রেখেছে পাহারায় প্রসিদ্ধ ধাত্রীকে,

সাথে আরো কিছু নারী, রাত্রিদিন,জাতে

সন্তান মাতা থাকে নিরাপদে।যেই

চক্ষু তাঁর ছুলো গিয়ে আমিনার গৃহ,

দেখতে পেল সে আম্বর মিশ্রিত জলে

ভেসে যাচ্ছে চারদিক আর তীব্র নুরে

জ্বলজ্বল করা তার ঘরের উপর

ও গৃহের চতুর্দিকে অসংখ্য

সুদর্শন পাখি করতেছে উড়াউড়ি

ছন্দময় যেন উড়তেছে না, করছে নৃত্য

শূন্যে ,যে ভাবে সমুদ্রে নাচে ঊর্মিমালা

দেখে তা , বেহুশ হয়ে গেল পথে

গোত্রপতি । ফিরে এলো সংজ্ঞা যেই,উঠে

দাঁড়ালো সে এল লাফে, যেন রণাঙ্গনে

ভূপাতিত কোন বীর। দাঁড়িয়ে পড়লো

ভীষণ অস্থির হয়ে আরব সর্দার

পুত্রবধূ আমিনার গৃহ অভ্যন্তরে

কি ঘটিতেছে, দেখতে স্বচক্ষে , অজানা

আশঙ্কায় কাঁপছে খালি বুক, কাছে গিয়ে

জুড়লো চিৎকার ‘আমিনা’ ! ‘আমিনা’ বলেঃ

“তুমি কি জাগ্রত? থাকলে উত্তর দাও”।

ছুটে এসে দাঁড়ালো প্রকন্ড নরমূর্তি

এক, পথ্রুদ্ধ করে; বলে উঠলো সে

জলদ্গম্ভীর স্বরে, “প্রবেশ নিষেধ

আরবনেতাকে, যিনি কাবার রক্ষক,

যার নামে পূর্ব ও পশ্চিমে নরনারী

ভক্তিতে নুয়ায় মাথা! সর্বোপরি আমি

আমিনার শ্বশুর; এ গৃহেরও মালিক!”

বলে ওঠে মনে মনে বৃদ্ধ মুত্তালিব।

কিন্তু তার তীক্ষ্ণ অগ্নিকয়লার মতো

চোখে চোখ রাখতেই অন্তরাত্মা তাঁর

হয়ে গেল হিম। চাইলো সে, দৌড়ে গিয়ে গিয়ে

টেনে তোলে নিদ্রা থেকে মক্কার সমস্ত

লোক; অতঃপর জানায় চিৎকার করে

ভয়ঙ্কর এইসব ঘটনার কথা

রুদ্ধশ্বাসে। কিন্তু তাঁর কন্ঠ অকস্মাৎ

হয়ে গেল স্তব্ধ; হলা দিয়ে কোন কথা

হলোই না বের; প্রস্তরের পায়ে হেঁটে

অগত্যা কাবার দিকে চললো সে ফিরে।

Back To Top