আব্দুল আজিজ আল আমান: বিভাগোত্তর পশ্চিমবাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চার সমন্বয়ী অগ্রনায়ক

~মোহাম্মদ সাদউদ্দিন

#ব্যক্তিত্ব

১৯৪৭-এ দেশভাগ। তারও আগে বাংলা ভাগকে নিশ্চিতকরণ। বিগত শতাব্দীর 50 ও 60 এর দশকে রাজনৈতিকভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হওয়া কিংবা সত্তরের দশকে পশ্চিমবাংলার মাটিতে নকশাল আন্দোলনের উত্তাল প্রবাহ। সময়টি এমনই যে, সে সময় বিপন্নতাবোধ করেই কলকাতা সহ পশ্চিমবঙ্গ থেকে একের পর এক সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে যেতে বাধ্য হন।

1964 সালের ষড়যন্ত্রমূলক দাঙ্গা। পশ্চিমবঙ্গে যেটুকু বা বাঙালি মুসলিম বুদ্ধিজীবী ছিলেন তারাও থাকতে পারলেন না। অবশ্য এই বিপন্নতাবোধ দুপারেই ছিল। তবুও বলবো পশ্চিমবঙ্গে এই সংকটকালে বাঙালি মুসলমানদের সাহিত্য-সংস্কৃতি- বৌদ্ধিক চর্চায় যে বা যিনি সমন্বয়ী মনোভাব নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন তাদেরই অন্যতম অগ্রনায়ক অবশ্যই আবদুল আজিজ আল আমান। পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ। আজকের বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি-সিনেমা জগতে যারা শীর্ষে অবস্থান করছেন তাদের একটি বড় অংশ জন্মসূত্রে ভারতীয় বা পশ্চিমবঙ্গের। আব্দুল আজীজ আল আমান কিছুদিনের জন্য তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (অধুনা বাংলাদেশ) অবস্থান করলেও আবার দেশের মায়ায় ফিরে আসেন কলকাতায়। ‘জাগরণ’, ‘কাফেলা’, নব কলবরে দ্বিতীয় পর্যায়ের ‘কাফেলা’ (১৯৮১), সাপ্তাহিক ‘নতুন গতি’ (১৯৮৪), ‘হরফ প্রকাশনী’ করে সংবাদ সাহিত্য সংস্কৃতি, প্রকাশনী জগতের এক নতুন দিশা তৈরি করেছিলেন। শুধু কি তাই? শিক্ষকতার চাকুরি ছেড়ে দিয়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি-সংবাদ- ও প্রকাশনা জগতে হিন্দু-মুসলিম- সমন্বয় ও দুই বাংলার সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে বড় ভুমিকা তিনি পালন করেন। আমান সাহেবের জাগরণ-কাফেলা-নতুন গতি – হরফ ছিল সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একটি স্বর্ণযুগ। তৈরি করেছিলেন এক লেখক গোষ্ঠী যারা মূল স্রোতের সাহিত্য পত্রিকা বা প্রকাশকদের চ্যালেঞ্জ দিতে পারতেন। এম আব্দুর রহমান, কবি মাহমুদুল হক, আব্দুর রাকিব, এ মান্নাফ, সৈয়দ আব্দুল বারি, আবু আতাহার, সৈয়দ আসরার আহমেদ, মহম্মদ আইয়ুব হোসেন, মাসুদ উর রহমান, ইবনে ইমাম, রফিকুল্লাহ, আব্দুর রউফ (নদীয়া), রবিউল হোসেন খান, খাজিম আহমেদ (বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ), আনোয়ার হোসেন, আব্দুর রেজ্জাক, হাফিজুর রহমান, এমদাদুল হক নুর, আব্দুর রব খান, ফিরোজা বেগম, আজরা বানু, মহম্মদ মতিউল্লাহ, আনজু বানু, সামশুল আলম, মুজতুবা আল মামুন সহ এক ঝাঁক কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক লেখককে আমরা পেয়েছি। কলেজ স্ট্রিটে হরফ প্রকাশনী করে মাত্র ৫ টাকা বা ১০ টাকায় রাম মোহন রচনাবলী, মধূসূদন রচনাবলী, দ্বিজেন্দ্র রচনাবলী ইত্যাদি তিনি পাঠকের হাতে তুলে দেন। হরফ প্রকাশনীর কর্ণধার হিসাবে তিনি কলকাতার কলেজ স্ট্রিট মার্কেটে একটি অভিনব দিক সৃষ্টি করেন। পশ্চিমবাংলায় বাঙালী মুসলমানদের এখন শিক্ষার হার বাড়ছে ঠিক কথা। বাঙালী মুসলিমদের হাতে পয়সা হয়েছে। অনেক নন-মেনুফাকচারিং শিল্পের কোটিপতি মালিকও রয়েছেন ঠিকই। তারা মিডিয়া-সংবাদপত্র-পত্রপত্রিকার ব্যাপারে উদাসীন। এই দুঃখবোধও আব্দুল আজীজ আল আমানের মধ্যে ছিল। তাই গ্রামে গ্রামে ঘুরেও তিনি সাধারণ মানুষের সাহায্য নিয়ে হরফ-কাফেলাকে শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করিয়েছেন। যেমন তিনি লেখক গোষ্ঠী তৈরি করেছিলেন, তেমনি মূলস্রোতের লেখক সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ, আব্দুল জব্বার, সুনীল-শীর্ষেন্দুদের সাথেও সম্পর্ক রাখতেন আমান সাহেব। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের কয়েকটি বইও প্রকাশ করেন আমান সাহেব। আবার তাকে দিয়ে দুই বঙ্গের গল্পকারদের দিয়ে একটি গল্প সংকলনের বইও বের করেছিলেন। কলকাতার কলেজ স্ট্রিট এলাকারাই নয়, পশ্চিমবঙ্গ তথা পূর্ব ভারতে বাংলাভাষী মানুষের কাছে আব্দুল আজীজ আল আমান একটি জনপ্রিয় নাম। বাংলাদেশের সঙ্গে সেতু বন্ধন গড়তে এই মানুষটির একটি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা ছিল। আল মাহমুদ, শামসুর রহমান, শহীদ কাদেরি, আল মুজাহিদী, ডঃ আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমেদ, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, বশির আল হিলাল, বদরুদ্দিন উমর, বুলবুল সারওয়ার- সবার সঙ্গেই তার যোগাযোগ ছিল। এটা বললে হয়তো অত্যুক্তি হবে না যে, আব্দুল আজিজ আল আমান হরফ-কাফেলা-নতুন গতি দুই বাংলার সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছেন। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় সেই সৃজনশীল ব্যক্তিত্ব, সংগঠক ব্যক্তিত্ব আব্দুল আজীজ আল আমান দুই বাংলায় একরকম বিস্মৃত। খোদ তার কর্মভূমি সেই কলকাতাতেই তার নাম বিস্মৃত। হরফ প্রকাশনীর কয়েকটি বিজ্ঞাপনের মোড়কে তার নাম দেখা যায় পত্রিকার বিজ্ঞাপনে অথবা স্মরণিকার পাতায়। যে আব্দুল আজীজ আল আমান একদিন কলকাতায় চালু করেন কাফেলা পুরস্কার, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও নজরুল পুরস্কার। কিন্তু তার নামে আজও কোন পুরস্কার চালু হয়নি। নজরুল পুরস্কার চালু আছে যেটি এখনো সেটি জিইয়ে রেখেছেন নতুন গতির সম্পাদক এমদাদুল হক নূর। এমনকি নুর সাহেব রাসুলুল্লাহ (সাঃ) পুরস্কার নবরুপে চালু করেছেন। আরো একটি কথা স্বীকার করতে হবে যে, আবদুল আজিজ আল আমান ব্যবসায়িক মহল বা কর্পোরেট মহল থেকে বিজ্ঞাপন নিয়েছেন। কিন্তু কর্পোরেট মহলের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দেননি। অথচ তিনি একজন ঝকঝকে গদ্যকার ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে যখন মূলস্রোতের পত্রপত্রিকা মুসলিম জীবনযাপন ও তাদের নানান দিক এড়িয়ে গেছে, যখন তাদের ইতিহাস ঐতিহ্য কে এড়িয়ে গেছে, তখন আবদুল আজিজ আল আমান সেগুলি তুলে ধরেছেন। আবার সমন্বয়ী সাহিত্য করতে গিয়ে বেদ-উপনিষদ-গীতা-হাদীসকে এক জায়গায় করেছেন। একজন মহান দ্রষ্টা হিসেবে তার অবদানকে অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে আজিজ আল আমান-এর সেভাবে মূল্যায়ন হয়নি। তার মাথায় বেল ভেঙ্গে যারা কামাচ্ছেন তারাও তাকে মনে রাখেননি। এটাই আমাদের কাছে দুঃখজনক। এটাই আমাদের কাছে দুঃখজনক যে, আমাদের সমাজই তাকে মনে রাখেনি। অথচ ‘আনন্দ পুরস্কার’ প্রদান অনুষ্ঠানে আনন্দ পাবলিশার্স তাকে নিমন্ত্রণ করে। এক্ষেত্রেও তিনি প্রথম মুসলিম ব্যক্তিত্ব। তাকে আনন্দবাজার গোষ্ঠীও সম্মান করতে বাধ্য হয়েছে।
১৯৮১-৮২ সাল। মুর্শিদাবাদের সালারের গ্রামে আমাদের বাড়িতে আনন্দবাজার ও দেশ বাদ দিলেও কাফেলা আসত। এছাড়া হরফ প্রকাশনীর আব্দুল আজিজ আল আমান-এর লেখা বই আসত। আবার আমান সাহেবের সম্পাদিত বিভিন্ন লেখকের রচনাবলীও আসত। তখন নবম-দশম শ্রেণীর ছাত্র। আমার আব্বা মোঃ নুরুজ্জামান ছিলেন পেশায় শিক্ষক। তার পড়াশোনার ঝোঁক ছিল। আমাদের পাশের নানীর এক চাচাতো ভাই মোহাম্মদ নুরুল আলম (নাইস) আমান সাহেবের খুব ভক্ত। সে সময় আজিজ আল আমান-এর কাফেলা পত্রিকা ছাড়াও হরফ প্রকাশনী বইও নাইস ভাই আনতেন। আমরা পড়তাম। কিন্তু সেরকম গুরুত্ব বুঝতাম না। কিন্তু ১৯৮৫-৮৬ সালে আমি তখন বীরভূমের সাঁইথিয়া অভেদানন্দ মহাবিদ্যালয় বি.এ অনার্সের ছাত্র। সে সময় আবদুল আজিজ আল আমান বীরভূমের সদরসহ সিউড়িতে আছেন। একটি সাহিত্য সম্মেলনে। কিন্তু সে সময় সামনে আসার সাহস হয়নি। ১৯৮৯ কি ১৯৯০ সালে হাওড়া নিবড়া হাইস্কুলে কাফেলা নতুন গতির একটি সাহিত্য বন ভোজন হয়েছিল। সে সময়ও তাকে কথা বলার সাহস হয়নি। তবে কবিতা পাঠ করেছি। অনেকের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। ১৯৮৮ সালে নতুন গতির ‘আরজ এই যে’ বিভাগে আমার একটি ‘সমালোচনার সমালোচনা’ শীর্ষক একটি লেখাও বের হয়। কিন্তু ‘কাফেলা’ নতুন গতি পড়া যোগাযোগ রাখা সবই ছিল।

যাই হোক, এবার আবদুল আজিজ আল আমান-এর আর যায় দোষগুণ থাক না কেন ব্যাক্তি আজিজ আল আমান আজ বিস্মৃত হয়ে যাচ্ছে। অবিভক্ত উত্তর 24 পরগনা (বর্তমান উত্তর 24 পরগনা) আমডাঙা থানার সোলেমানপুর গ্রামে ১৯৩২ সালের ১০ মার্চ তিনি জন্মগ্রহণ করেন এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে। ১৯৪৭ সালে দেশ যখন স্বাধীন হয় তখন মাত্র ১৫ বছরের কিশোর আজিজ সাহেব। কিন্তু তার বোধের জায়গাটা যথেষ্ট উন্নত ছিল। দেশভাগ দ্বিজাতি তত্ত্ব বিভাজন সবই তার মনের মধ্যে গেঁথে ছিল। উপলব্ধি করেছিলেন বাস্তব পরিস্থিতি। উভয় পারের বা পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু বিপন্নতাবোধ যেমন উপলব্ধি করেন, তেমনই তাদেরও একটি গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে সে সম্পর্কেও পূর্ণমাত্রায় সচেতন ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স ডিগ্রিধারী আবদুল আজিজ আল আমান হতে পারতেন একজন ভালো শিক্ষক কিংবা অধ্যাপক। কিন্তু না, শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে দিয়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বজবজ-বাটানগর এলাকার মেয়ে মরিয়ম আজিজকে সহধর্মিনী হিসেবে পেয়ে সাহিত্য-সাংবাদিকতায় জীবন অতিবাহিত করেন। ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে বিভাগোত্তর পশ্চিমবাংলায় নজরুলকে নিয়ে মুষ্টিমেয় কয়েকজন কাজ করলেও আজিজ সাহেব ‘অপ্রকাশিত নজরুলকে’ কাফেলার পাতায় ধারাবাহিক বের করেন। এদিকটা পরে আসবো। শিক্ষকতা জীবনে বের করেন ‘আওয়াজ’, ‘প্রগতি’, ‘বেগম’, ও ‘জাগরন’। ‘জাগরনের’ পর ১৯৬৬ সালে প্রথম পর্বের ‘কাফেলা’ ও ১৯৮১ সালে দ্বিতীয় পর্বের ‘কাফেলা’ বের করেন তিনি। তার আগেই হরফ প্রকাশনী। খুলে যায় মুসলিম লেখকদের ক্ষেত্র। ১৯৮৪ সালে ‘সাপ্তাহিক নতুন গতি’ মুসলিম সাংবাদিকতার পথকে প্রশস্ত করে। সেক্ষেত্রে আবদুল আজিজ আল আমান এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ‘হরফ’ প্রকাশনী থেকে আবদুল আজিজ আল আমান এর উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, প্রবন্ধ, কবিতা, সম্পাদিত গ্রন্থ, রচনাবলী, ইসলামী সাহিত্য বিষয়ক গ্রন্থ মিলে ৬০টি গ্রন্থ রয়েছে। একবার তার গ্রন্থ গুলির দিকে নজর দেওয়া যাক-

১. কাব্য গ্রন্থ বা কবিতার বই
1.আমার বাগানে লাইলি
2.ফেরা
3.এই কণ্ঠ অন্য স্বর
4.ধবল জোছনার সম্রাট
5.আকণ্ঠ একরাতে

২. গল্প সংকলন/গল্পের বই
১. সোলেমানপুরের আয়েশা খাতুন
২. শেখজি ও দ্বিতীয় পক্ষ
৩. সালমা-শাহেদ-শিরিন
৪. বাদামতলির মৃত্যু
৫. আল আমানের প্রেমের গল্প
৬. আল আমানের শ্রেষ্ঠগল্প

৩. উপন্যাস
১. শাহানী একটি মেয়ের নাম
২. সাকিনার সংসার
৩. চন্দন দ
৪. হেমকপুরের কথকতা

৪. ভ্রমণ
১. কাবার পথে (মক্কা পর্ব)
২. কাবার পথে (মদিনা পর্ব)

৫. সম্পাদিত গ্রন্থ
১. আল কুরআন
২. রামমোহনের রচনাবলী
৩. মধুসূদন রচনাবলী
৪. দীনবন্ধু রচনাবলী
৫. দ্বিজেন্দ্র রচনাবলী
৬. বঙ্কিম রচনাবলী
৭. বিষাদসিন্ধু
৮. নজরুল রচনাসম্ভার
৯. নজরুলগীতি
১০. রাঙা জবা
১১. নজরুলের ইসলামী সংগীত
১২. শ্রেষ্ঠ নজরুল সংগীত
১৩. শ্রেষ্ঠ নজরুল স্বরলিপি
১৪. অপ্রকাশিত নজরুল
১৫. দ্বিজেন্দ্রগীতি
১৬. বেদ সংহিতা
১৭. বিদ্রোহী বিচিত্রা
১৮. নজরুল কিশোর সমগ্র
১৯. চার খলিফার বিচিত্র জীবনকথা

৬. রচনাবলী
১. আল আমান রচনাবলী-প্রথম খন্ড
২. আল আমান রচনাবলী-দ্বিতীয় খন্ড

৭. প্রবন্ধের বই
১. নজরুল পরিক্রমা
২. ধূমকেতুর নজরুল
৩. রৌদ্রময় ভূখণ্ড
৪. অনন্তের দিকে
৫. পদক্ষেপ
৬. সাহিত্যসঙ্গ
৭. বিশ্বাসের ঘরবাড়ি

৮. সিরাত বা ইসলাম বিষয়ক কিশোর গ্রন্থ
১. আলোর রসুল আল আমীন
২. শিশুদের নবী
৩. ছোটদের মহানবী
৪. হযরত ইব্রাহিম (আঃ)
৫. হযরত সালেহ (আঃ)
৬. হযরত হুদ (আঃ)
৭. আলোর আবাবিল
৮. হযরত ফাতিমা (রাজিঃ)
৯. বেহেস্তের পাখিরা
১০. মক্কা মদিনার পথে
১১. ধন্য জীবনের পুণ্য কাহিনী

সাহিত্য পত্রিকা, সংবাদপত্র সম্পাদনা ও একটি প্রকাশনা সংস্থা চালনা করেও মাত্র ৬২ বছরের জীবদ্দশায় পাঁচ ডজন বইয়ের ডালি সাজানো কিন্তু কম কথা নয়। আর এখানেই আব্দুল আজিজ আল আমানের সৃজনশীলতার স্ফুরণ। এখানেই আজিজ আল আমানের মৌলিকত্ব ও স্বকীয়তা। এখানেই তো তার বিশেষত্ব। দেশভাগের পর কলকাতার কথা সাহিত্যিক দু-একজন বাদ দিলে মুসলিম জীবন যাপনের বিষয়টি উঠে আসেনি। আজিজ আল আমানের গল্পগ্রন্থ ‘সোলেমানপুরের আয়েশা খাতুন’, ‘শেখজি ও দ্বিতীয় পক্ষ’, ‘সালমা-শাহেদ-শিরিন’, ‘বাদামতলির মৃত্যু’, ‘আল আমানের প্রেমের গল্প’, ‘আল আমানের শ্রেষ্ঠ গল্প’ বইয়ে তা উঠে এসেছে। আবার তা সর্বজনীনও হয়েছে।

আব্দুল আজিজ আল আমান ছিলেন উত্তর ২৪ পরগণার আমডাঙ্গা থানার সোলেমানপুর গ্রামের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। পিতার নাম ছিল মরহুম ওয়াসিমউদ্দিন (লোকে ওসিমুদ্দিন বলতেন)। মাতার নাম মরহুমা রজিমুন্নেসা। আজিজ সাহেবের বিয়ে হয় দক্ষিন ২৪ পরগণার মহেশতলা থানার নুঙ্গি-চপচান্দুল (বাটানগর) গ্রামের বিখ্যাত জমিদার সেখ গুল মাহমুদের একমাত্র কন্যা বেগম মরিয়ম আজিজের সঙ্গে। কিন্তু না, আজিজের উপন্যাস সাহিত্যে এসেছে নিম্ন ও দরিদ্র শ্রেণির বাঙালী মুসলিম পরিবারের চালচিত্র। ‘শাহানী একটি মেয়ের নাম’, ‘সাকিনার সংসার’, ‘চন্দন দ’, ‘হেকমপুরের কথকতা’– চারটি উপন্যাসে সেই চালচিত্র ফুটে উঠেছে। গ্রামীণ জীবনের প্রেম ভালোবাসা, সামাজিক ও অর্থনীতি জীবন সহ নানান সমস্যা আজিজের কথা সাহিত্যে ফুটে উঠেছে। বলা ভালো উঠে এসেছে।
আব্দুল আজিজ আল আমানের বড় কৃতিত্ব হল নজরুল সাহিত্যের মূল্যায়ন ভিত্তিক গ্রন্থ রচনা। ‘কাফেলা’ পত্রিকার মাধ্যমে ‘অপ্রকাশিত নজরুল’কে তুলে ধরা হয়। পশ্চিমবঙ্গের আজহারউদ্দিন খান, এম আব্দুর রহমান, জিয়াদ আলি, মাজহারুল ইসলাম, কল্পতরু সেনগুপ্ত, বাঁধন সেনগুপ্ত, প্রাণতোষ চট্টোপাধ্যায়, অঞ্জন বেরা, সেখ আজিবুল হক, সহ আরও অনেক লেখক গবেষক নজরুলকে নিয়ে কাজ করেছেন ঠিকই কিন্তু আজিজ সাহেব এক্ষেত্রে অনেক ব্যাপক পরিসরে কাজ করেছেন। ‘নজরুল পরিক্রমা’, ‘ধূমকেতুর নজরুল’, ‘অপ্রকাশিত নজরুল’, ‘নজরুল কিশোরসমগ্র’, ‘বিদ্রোহী বিচিত্রা’ প্রভৃতি গবেষণামুলক গ্রন্থগুলি জ্বলন্ত উদাহরণ। এছাড়াও আজিজ সাহেবের নজরুল বিষয়ের সম্পাদিত গ্রন্থ ‘নজরুল রচনা সম্ভার’, ‘নজরুল গীতি’, ‘রাঙা জবা’, ‘নজরুলের ইসলামী সঙগীত’ ও ‘শ্রেষ্ঠ নজরুল স্বরলিপি’ কবি ও সুর সাধক নজরুলকে পাঠক সমাজের কাছে আরও বেশি গভীরে নিয়ে গেছে।
আব্দুল আজিজ আল আমান জীব্রাইল সেখ, ইবনে ওসিমুদ্দিন ও সোলেমান- এই তিনটি ছদ্মনামে লিখতেন। ‘কাফেলা’ পত্রিকায় নজরুলের অনেক হারিয়ে যাওয়া লেটোগান ছাপা হয়েছিল যেগুলি উদ্ধার করেন বিশিষ্ট গবেষক আইয়ুব হোসেন।
আমরা একটা কথা ভুলে যাই যে, কাজী নজরুলের ইসলামের পর সিরাত বা ইসলামী সাহিত্যে আজিজ সাহেব ঐতিহাসিক অবদান রেখে গেছেন। একটা কথা হল, মুসলিমদের মধ্যে যারা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হন তারা আরবী উর্দু বা ইসলামী শিক্ষায় ততখানী দক্ষ হন না। আবার যারা মৌলবি, মৌলানা হন তারা বাংলা ইংরেজি সহ সাধারণ শিক্ষায় সেরকম দক্ষ নন। আব্দুল আজিজ আল আমান এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তিনি দুক্ষেত্রেই কাজী নজরুল ইসলামের মতই পারদর্শী ছিলেন। আর ছিলেন বলেই, আরবীর বাংলা উচ্চারণের শুদ্ধিকরণের বইও লিখে যান। ‘কাবার পথে’ (মক্কা পর্ব), ‘কাবার পথে’ (মদিনা পর্ব), ‘মক্কা মদিনার পথে’, ‘মানুষের নবী’, ‘আলোর রসুল আল আমীন’, ‘আলোর আবাবিল’, ‘রৌদ্রময় নিখিল’, ‘অনন্তের দিকে’– গ্রন্থগুলি উৎকৃষ্ট সিরাত সাহিত্যে এক একটি উৎকৃষ্ট ফসল। কাবার পথের দুই পর্বকে ভ্রমণ সাহিত্য বলা হলেও তার মধ্যেও এসেছে নবী জীবনের নানান দিক, ইসলামী ইতিহাস ঐতিহ্য। আলোর আবাবিল এর একটা বড় অংশ ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল।

আজিজ সাহেব কলকাতায় মাসিক সাহিত্য আড্ডা ও বনভোজন চালু করে কলকাতা সহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের সাথে একটি যোগসূত্র স্থাপন করেন। আবার বার্ষিক সাহিত্য সম্মেলন করে আসাম, ত্রিপুরা, বাংলাদেশ সহ উপমহাদেশের বাংলাভাষী মানুষের মধ্যে সেতুবন্ধন করেছিলেন। এর গুরুত্ব অপরিসীম। কলকাতার আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দু-একজন ছাত্রছাত্রী বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা তাকে নিয়ে গবেষণা করছেন। তাকে নিয়ে গবেষণার দরজা আরও প্রসারিত হোক। তাকে নিয়ে আরও বেশি করে মূল্যায়ন করুক।
এবার 2020 সালের কলকাতা বইমেলায় আব্দুল আজীজ আল আমানের চারটি গল্পসংকলন ও দুটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। হরফ প্রকাশনী এগুলি বের করেছে।

Back To Top